মি. হক একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপক । প্রতিষ্ঠানের প্রতিটা কাজে তিনি হিসাব করে চলেন । নতুন বছর শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলতি বছরের সর্বশেষ হিসাব বিভাগীয় ব্যবস্থাপকগণের নিকট থেকে সংগ্রহ করে ও পূর্ববর্তী বছরগুলোর হিসাব বিবেচনায় নিয়ে তার ওপর একটা ভাবনা দাঁড় করান । অতঃপর বিভাগীয় ব্যবস্থাপক ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী বছরের মূল প্রতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন । ধরা যাক, নির্ধারিত হলো সামনের বছরে চলতি বছরের তুলনায় ২০% বিক্রয় বৃদ্ধি করতে হবে । সে অনুযায়ী তিনি উৎপাদন ও বিক্রয় ব্যবস্থাপকদের স্ব স্ব বিভাগীয় পরিকল্পনায় ৩০% বৃদ্ধির টার্গেট ধরে ত্রৈমাসিক বিভাজনসহ বিভাগীয় পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিলেন । বিভাগসমূহের লিখিত পরিকল্পনা তার নিকট জমা হলে তিনি ত্রুটি- বিচ্যুতি সংশোধন করে পরিকল্পনা অনুমোদন করলেন । অতঃপর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ও বিভাগীয় পরিকল্পনাসমূহ লিখিত আকারে বিভাগগুলোতে পাঠানো হলো । প্রয়োজনে তিনি স্ব-স্ব বিভাগে যেয়ে বসে তাদের টার্গেট ও করণীয় ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন । সমস্যা থাকলে তার সমাধানের পন্থাও নির্দেশ করলেন । বছর শেষে দেখা গেল প্রতিষ্ঠানটি তার টার্গেট পূরণে সফল হয়েছে ।
মি. হকের প্রতিষ্ঠানের গৃহীত পরিকল্পনাকে উত্তম পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা হলে তার যে সকল বৈশিষ্ট্য আলোচনার দাবি রাখে তা নিম্নরূপ:
১. সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য (Specific objective) : কাঙ্ক্ষিত ফল যাকে ঘিরে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাকেই প্রতিষ্ঠানের বা কাজের উদ্দেশ্য বলে । পরিকল্পনা প্রণয়নে এর সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য প্রথমেই নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক । উদ্দেশ্যবিহীন পরিকল্পনা কখনই কার্যকর ফল দিতে পারে না । তাই একটি আদর্শ পরিকল্পনা অবশ্যই সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক হয়ে থাকে । প্রতিষ্ঠানে সামগ্রিক একটা উদ্দেশ্য যেমনি থাকে তার আলোকে প্রত্যেক বিভাগ-উপবিভাগেরও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ।
২. বাস্তবমুখিতা (Reality oriented) : পরিকল্পনা অবশ্যই বাস্তবমুখী হতে হয়। বাস্তবমুখিতা বলতে ভবিষ্যৎ অবস্থা বিবেচনায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নযোগ্য হওয়াকে বুঝায় । বৃহত্তর উদ্দেশ্য এবং তার আলোকে একটি বড় ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই তা সুফল দিতে পারে না। অবাস্তব পরিকল্পনা সবার মাঝে তাৎক্ষণিক কিছুটা আশাবাদ সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেও কার্যক্ষেত্রে তা কখনই কাঙিক্ষত ফল দেয় না। বরং পরবর্তীতে তা হতাশা ও নানান ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে ।
৩. গ্রহণযোগ্যতা / পালনযোগ্যতা (Acceptability) : পরিকল্পনা যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের কর্তৃক উক্ত পরিকল্পনা পালনযোগ্য মনে করে সাদরে গ্রহণ করাকেই পরিকল্পনার গ্রহণযোগ্যতা বলে । পরিকল্পনা যাদের দ্বারা বাস্তবায়িত হবে তাদের নিকট এটি গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। কর্মীরা যদি পরিকল্পনাকে কোনো কারণে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে না পারে তবে তার সঠিক বাস্তবায়ন আশা করা যায় না । এজন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বা অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থাপনা (Participative management)-এর প্রতি আজকাল গুরুত্বারোপ করা হয় ।
৪. সঠিক পথ-নির্দেশনা (Proper guidance) : বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করণীয় বিষয়ে পরিকল্পনা থেকে যেন নির্দেশনা পাওয়ার সম্ভব হয় এটা নিশ্চিত করাকেই পরিকল্পনার সঠিক পথনির্দেশনা বলে । একটা প্রণীত পরিকল্পনা অবশ্যই সঠিক পথ নির্দেশক হওয়া উচিত। যাতে তা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সঠিক পথ-নির্দেশ করতে পারে। এজন্যই Koontz & O. Donnell পরিকল্পনাকে দর্পন (Looking glass) এর সাথে তুলনা করেছেন । কী কী কাজ করা হবে পরিকল্পনা তার দিক নির্দেশে ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়াই স্বাভাবিক । এজন্য যতদূর সম্ভব পরিকল্পনা বিশদ বর্ণিত ও পূর্ণাঙ্গ হওয়া উত্তম ।
৫. সমন্বয় ও যোগসূত্র (Co-ordination and linkage) : বিভিন্ন পর্যায়ে গৃহীত পরিকল্পনাকে মূল লক্ষ্যের আলোকে একসূত্রে সংযুক্ত করার কাজই হলো পরিকল্পনায় সমন্বয় ও যোগসূত্র স্থাপন । প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরেই যেহেতু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয় তাই একটি আদর্শ পরিকল্পনায় সকল স্তর বা বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ও যোগসূত্র রক্ষা করা হয়ে থাকে । প্রতিষ্ঠানের মূল পরিকল্পনা-পূর্ব সময়ে গৃহীত পরিকল্পনার সাথে এবং বিভিন্ন স্তরে গৃহীত পরিকল্পনা মূল পরিকল্পনার সাথে সমন্বিত হওয়া আবশ্যক। বিক্রয় বিভাগ ও উৎপাদন বিভাগের পরিকল্পনায় যোগসূত্রিতা না থাকলে উভয় পরিকল্পনায় যে অকার্যকর-তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
৬. নমনীয়তা (Flexibility) : পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বিধানের সামর্থ্যকে নমনীয়তা বলে। একটি উত্তম পরিকল্পনায় নমনীয়তার সুযোগ থাকা আবশ্যক । সম্ভাব্য যে সকল আবস্থার মধ্য দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে বলে ধরে নিয়ে পরিকল্পনা প্রণীত হয় তা সবসময় মিলবে এমন আশা করা যায় না । তাই অবস্থার পরিবর্তন হলে যতটা সম্ভব দ্রুততার সাথে পরিকল্পনা সংশোধন করতে হয়। পরিকল্পনা প্রণেতাগণ যদি আগে থেকে বিকল্প অবস্থায় করণীয় ঠিক করে রাখেন সেক্ষেত্রে এরূপ পরিবর্তন সহজ হয়ে থাকে। যাকে পরিস্থিতিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা বলে । নমনীয় বাজেট (Flexible budget) তৈরি এর একটি উত্তম উদাহরণ ।